ইয়াহিয়া খান রুবেল, গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : শহরাঞ্চলের দোকান বা ফুটপাত থেকে ভেজাল ও অপরিপক্ক আম নিয়ে ঠকেননি এমন ভোজনরসিক মানুষ খুব কমই আছেন। এক আম অন্য নামে কেনা, দেখতে সুন্দর হলেও ভিতর পঁচা – পোকা কিংবা স্বাদহীন আম নিয়ে ঘরে গিয়ে খাবার সময় হতাশও হতে হয় অনেককে। এসব কারণে সতেজ, পরিপক্ক ও সুমিষ্ট আমের জন্য, আম প্রিয় মানুষদের দৃষ্টি থাকতো আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে। আর একটা সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষদের সঙ্গে পরিচয় থাকলে আম মৌসুমে তাদের অনুরোধ করে অনেক কষ্টে মিলতো সতেজ ও সুমিষ্ট আম। এসবের দিন এখন শেষ হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইনের মাধ্যমে সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুস্বাদু আম মানুষ এখন ঘরে বসেই পাচ্ছেন খুব সহজে ও নায্য দামে।
রহনপুরের আম বাজার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মধ্যে একটা অন্যতম আম বাজার। রহনপুর আম বাজারে এখন গেলেই চোখে পড়বে প্রায় শ,খানেক তরুণ অনলাইন আম ব্যাবসায়ীর। ফেসবুক পেজ কিংবা ফোনে আমের অর্ডার পেলেই এরা বাগান কিংবা বাজারে চলে আসেন। সারাদিনই এদের দেখা মেলে। মনযোগ দিয়ে আমের গুণগত মান পরীক্ষা আর মূল্য নিশ্চিত হলে আম সংগ্রহ করে বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস বা ট্রেনের মাধ্যমে এরা আম পাঠিয়ে দেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো অনলাইনের আম ব্যাবসায়ীরা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। এসব ব্যবাসায়ীরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন নামকরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্বাভাবিক জীবন যাপনও সীমাবদ্ধ। পড়াশোনার পাশাপাশি এদের কেউ কেউ পার্টটাইম চাকরি করতেন। করোনায় এসবও বন্ধ। তাই বেকার না বসে থেকে ছাত্রদের অনেকে এখানে নেমে পরেছেন অনলাইনে আম ব্যাবসায়। পরিচিত মানুষজনই এদের কাস্টমার আবার ফেসবুকে পেজেও তারা অর্ডার পান আমের দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
রহনপুর আম বাজারে এক চা আড্ডায় দেখা মিললো সজিব বিশ্বাস, তাসরিফ আহমেদ, নাহিদুজ্জামান, এখলাসুর রহমান, শাহরিয়ার কবির রাতুল, রিফাতুজ্জামান, জসিম আলী, সুজন, তুষার কাদরী, নাজমুল হক, সিফাত খান, নাঈম ইসলাম, শামীম বিশ্বাস, ইসমাইল হোসেন, রিপন, হাসান আলী মন্ডল হিমেল, অমিত সহ অরো অনেকের। সবাই বয়সে তরুণ। এদের কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গোপালগঞ্জ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী কলেজ, রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারী কলেজ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কমার্স কলেজের ছাত্র। প্রত্যেকেই ফেসবুকে পেজ খুলেছেন ব্যবসার জন্য। বাহারী নামের পেজগুলোর নামেও রয়েছে সৌন্দর্য। ফেসবুকে আম বাজার বিষয়ে সার্চ দিলে চোখে পড়বে ম্যাংগো সার্ভার্স, হ্যালো ম্যাংগো, পিওর ম্যাংগো, আম সওদাগর, চাঁপাই ম্যাংগো ফ্রুটস, চাঁপাই আম ভান্ডার, ম্যাংগো কিংডম, আম মানেই চাঁপাই, ওয়ান্ট চাঁপাই ম্যাংগো, চাঁপাই ফ্রেশ ম্যাংগো, চাঁপাই ম্যাংগো কর্ণার, আম সেবা, চাঁপাই আম ওয়ালা ইত্যাদি পেজগুলো।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অহিদুর রহমান অমিত বলেন, করোনার জন্য দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। আর পরিচিত জনরা জানেন আমার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এজন্য ফোনে কিংবা ফেসবুকে অনেকেই আম পাঠাতে বলতেন, খোঁজ খবর নিতেন। তাই মাথায় আইডিয়া আসলো, অলস বসে না থেকে অনলাইনে আমের ব্যবসা করা যেতে পারে। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে। তাই তিনি আমের ব্যবসা শুরু করেন। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহরিয়ার কবির রাতুল বলেন, মানুষ সতেজ আম চান, চাঁপাইয়ের আম খেতে চান। কিন্তু করোনার জন্য অনেকে বাজারে আসতে পারেননা অথবা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসাটা অনেক খরচের। একারণে অনলাইন সবাই বেছে নিয়েছেন। বলেন, ভালই অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই তারা প্রায় ৫ মন থেকে শুরু করে ৪০ মন পর্যন্ত আম পাঠাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। রাজশাহী কোর্ট কলেজের ছাত্র রিফাতুজ্জামান রিফাত ও রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজের ছাত্র সিফাত খান বলেন, আর্থিকভাবে তারা লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই ৫০০ থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত একদিনে আয় করছেন।
করোনার কারণে এবার অনলাইন ব্যাবসায়ীদের জন্য বাজারের অবস্থা অনেক ভাল। আম চাষী ও আম চাষী সমিতির সভাপতি আফতাব হোসেন লালান বলেন, বিধি নিষেধের কারণে অনেকেই বাজার আসছেননা। তাই অনলাইনে অর্ডার দিচ্ছেন। অনলাইন আম ব্যাবসায়ীদের কারণে বাজার কিছুটা চাঙ্গা আছে। এরা না থাকলে আম চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হতো রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহ. হবিবুর রহমান বলেন, এটা খুব প্রশংনীয় ব্যাপার ছাত্ররা পড়ালিখার পাশাপাশি বেকার বসে না থেকে সৃষ্টিশীল কাজ করে সে আয় দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করছেন। এতে করে তারা আরো আত্মবিশ্বাসী ও কর্মঠ হচ্ছেন। আগামীতে এরাই হয়তো বড় উদ্দোক্তা হবে। তাদের স্বাগত জানান তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, অনলাইন এক্টিভিটিজ বা ই-কমার্সের মাধ্যমে বেচা-কেনা হলে এ করোনার মধ্যে ফিজিক্যালি যোগাযোগটা কমে যাবে। সে ক্ষেত্রে করেনার সংক্রামন প্রতিরোধ হবে এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ করা সহজ হবে। এদেরে মাধ্যমে আম চাষীরা উপকৃত হচ্ছে এবং ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারছে।
এ ব্যপারে স্থানীয় সরকার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর উপ-পরিচালক এ.কে.এম তাজকির-উজ-জামান বলেন গত ২১জুন জেলা প্রশাসন ১০০ জাতের আম নিয়ে একটি এ্যালবাম প্রকাশ করেছে। এই এ্যালবাম থেকে ভবিষ্যতে আরও আম পেতে এবং খেতে সাহায্য করবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম অনলাইনে বিক্রির সিস্টেম এ জেলার জন্য আর্শিবাদ বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তবে সেক্ষেত্রে যারা ব্যবসা করছে মূলত কুরিয়ার সার্ভিসের উপর নির্ভরশীল। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো আম যথা সময়ে পৌঁছায় না। এ বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ তাদের কাছে আছে। বিষয়টি সর্তকর্তার সাথে দেখছেন তারা।