সেলিম সানোয়ার পলাশ : গোদাগাড়ীর একটি হোটেলে চা খাওয়ার সময় কথা হয়, ৮ বছর বয়সের সুমনের সাথে। হোটেলে সে পিলেট পরিস্কার করছিল। পানি চাইতেই এক গ্লাস পানি নিয়ে হাজির সুমন।
কত দিন ধরে হোটেলে কাজ কর ? চট করে উত্তর দিল ৪/৫ মাস ধরে কাজ করি। লেখা পড়া কর না? কাশ টুতে পড়েছি।
স্কুল যাও না ? না এখন আর স্কুলে যায় না, স্কুলে গেলে খাব কি ? বাড়িতে কে আছে ? মা ও ছোট বোন। বাবা মারা গেছে । মা অন্যের বাড়ীতে কাজ করে। আমি হোটেলে কাজ করে ৩০ টাকা পাই। সেই টাকা মাকে দিয়।
এমন সময় ডাক দিল হোটেল মালিক ওই ওখানে কি করছিস, কাজ কে করবে ? আর কোন কথা না বলেই সুমন চলে গেল আবার পিলেট পরিস্কার করতে। সুমনের রঙিন স্বপ্ন গুলো সুমনকে আর বাধাঁ দিতে পারে না।
কাজ করে অর্থ উপার্জনই তার স্বপ্ন। দারিদ্রতা সুমনের রঙিন স্বপ্ন গুলোকে ভুলিয়ে এই বয়সে কাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। দারিদ্রের কসাঘাতে সুমনের মত বিভিন্ন পরিবারের শত শত শিশু বিদ্যালয়ে পা না দিতেই জীবিকা অর্জনের জন্য কর্মেেত্র ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যে বয়সে শিশুদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সে বয়সে তারা জীবিকার টানে হোটেল-রেস্টুরেন্ট, চায়ের স্টল, ইট ভাঙা, নির্মাণ কাজ, ইট ভাটায়, ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ, রিকশা চালানো, টেম্পোর হেলপার, দোকান কর্মচারী ও হকারীসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। তারা নিজেদের ভবিষৎ জীবনের চিন্তা না করে স্কুলে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে তাদের আজ নানা ধরনের কাজের কথা ভাবতে হচ্ছে।
দারিদ্রতা বড় বাধা হয়ে দাড়িয়েছে কমলমতী শিশুদেও স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে খেলাধুলা ও হৈহুল্লুরে।
উপজেলায় নসিমন চালক সবুজ, হাকিম ও ফারুক এদের কারো বয়স ১১ থেকে ১২।
এসব শিশুর কোনো দিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পাঁচ বছর বয়সেই সংসারের অভাব অনটনের কারণে কাজে নামতে হয়েছে দরিদ্র পরিবারের এসব সন্তানদের। কাক ডাকা ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাদের কাজে নামতে হয় আর শেষ হয় গভীর রাতে।
এর বিনিময়ে মালিকদের কাছ থেকে তিন বেলা খাবার, বছরে দুই খানা লুঙ্গি, একটি জামা, একটি গামছা প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টাকা জোটে ওদের ভাগ্যে। এমনকি অনেক শিশু শ্রমিকের ভাগ্যে দু বেলা খাবার ছাড়া কিছুই জোটেনা।
মালিকেরা বলে আগে কাজ শিখতে হবে। কাজ শেখানোর নামে শিশু শ্রমিকদের অমানুষিক ভাবে কাজ করিয়ে নেই ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। অমানুষিক শ্রম, অবহেলা অনাদরে মহাজনের বাড়িতে থাকতে হয় ওদের। সব মিলিয়ে গোদাগাড়ীতে শত শত শিশুশ্রমের একটি বাস্তব নমুনা মাত্র।
ভ্যান চালক শিশু শ্রমিক হাবিব(১১) এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার বাবা নেই, মা তাকে স্কুলে ভর্তি করেছিল। কিন্তু আর্থিক অভাবের কারণে ৪র্থ শ্রেনীতে স্কুল ছেড়ে ভ্যান চালাতে হচ্ছে।
এ উপজেলায় শিশু শ্রম সহজলভ্য হওয়ায় এখানকার ব্যবসায়ীরা শিশু শ্রমিকদের প্রতি বেশি আগ্রহী। শিশু শ্রমিক পেলে তারা অন্য শ্রমিক নিতে চাই না।
অনেক এনজিও কাগজে কলমে শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করলেও বাস্তবে এ উপজেলায় শিশুদের নিয়ে উল্টো চিত্র এনজিও গুলোর। এ ব্যাপারে মানবাধিকার কর্মী তাহাজুল ইসলাম জানান, ওই সব অসহায় শিশুরা অনাদর ও অবহেলায় বড় হচ্ছে।
এক সময় তারা ভালো পরিবেশ না পেয়ে কেউ কেউ মাদকাসক্ত হচ্ছে। আবার কেউ সমাজে বিভিন্ন খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে।
তাই তাদের শিশু শ্রমে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠালে সুন্দর সমাজ গড়তে সকলকে এক সঙ্গে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।