আব্দুল খালেক :
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে ধরা হয়। আসলে বিষয়টি এমন নয়, সারা দেশেই কম বেশি মাদক ব্যবসা হচ্ছে কিন্তু গোদাগাড়ী এটি সীমান্তঘেঁষা এলাকা হিসেবে একটু বেশি হচ্ছে বৈকি। কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, পানের দোকান, হার্ডওয়্যার, গার্মেন্টর্স কিংবা অন্যান্যরা ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসা করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাচ্ছেন অনেকেই।
উপজেলার মাদারপুর, ডিমভাঙ্গাসহ বিভিন্ন গ্রামে মাদককারবার করা হয়। ভারতের মাদককারবারীরা হেরোইন, ফেন্সিডিল, ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক কাঁটা তারের বেড়ার ওপাশ থেকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নিকটে নিরাপদে পার করে দেয়। মাঝে মধ্যে মাদকের বাহকরা ধরা পড়লেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় রাঘব বোয়ালরা।

স্কুল, কলেজের উঠতি বয়সের ছেলেদের দেখা যায় খুব ঘন ঘন বাইক পরিবর্তন করছে। হাতে নতুন নতুন মোবাইল ফোন। চলনে বলনে ভিন্নতা। মানুষ সহজেই বুঝতে পারে ‘ডালমে কুচ কালা হ্যায়’।

উপজেলার ডাইংপাড়া, সুলতানগঞ্জ, পিরিজপুর, রাজাবাড়ীহাট ইত্যাদী বাজারের সামনের দোকানগুলোর ভাড়া অনেক বেশি। সাধারণ প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ওসব দোকানগুলো নিতে হিমশিম খায়। ডাইংপাড়ায় প্রথম সারির দোকানগুলোর ভাড়া প্রতি মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা। সাথে আছে ৩ বছরের ১০-১৫ লক্ষ টাকা অগ্রীম জামানত। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এসব দোকানগুলোতে এতদিন ব্যবসা করে আসলেও এখন অতিরিক্ত ভাড়া ও জামানতের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন বা দোকান ছেড়ে দিয়ে মার্কেটে ভিতরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।  এখানেও মাদক ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে বলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের ধারনা।

বাজারের বড় বড় মাছগুলো সাধারণ মানুষ কিনতে না পারলেও গডফাদাররা দামাদামি না করেই নিয়ে চলে যায়।

এছাড়াও উপজেলার প্রাচীর না থাকা বিদ্যালয় যেমন গোদাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ, সুলতানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, শাহসুলতান রহ. কামিল মাদরাসা, সেখেরপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঠগুলোতে সন্ধাবেলা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত মাদকের পসরা সাজিয়ে সেবন ও বিক্রয় করা হয়। মাঠগুলো মাদক সেবনের নিরাপদ জায়গা হিসেবে ধরা হয়। উপজেলার আইন শৃঙ্খলা কমিটির মিটিং এ মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কাজ করার কথা বলা হলেও কার্যত তেমন উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।

চোলাইমদ সাঁওতাল পল্লীর প্রায় মানুষ খেয়ে থাকে। এটা তার নিজেরাই বানিয়ে নিজেরায় খায়। এগুলো নাকি তাদের খাওয়ায় লাগে।  সেই সাথে মুসলমানদের অনেকেই সাওঁতালপল্লীতে  খেতে যায়। সেই চোলাই মদ উপজেলা নির্বাহী অফিসার কয়েকবার অভিযান চালিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এমন অভিযানকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।

১৫ মার্চ ২০২৫ সুলতানগঞ্জ গ্রাম থেকে ২ নারীকে ৫ কেজি হেরোইনসহ আটক করে গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশ। ১৯ জুন, লালবাগ গ্রামের আদিল নামক এক মাদক ব্যবসায়ীকে নিজ বাড়ী থেকে ৩১৫ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করে র‌্যাব-৫। ২২ এপ্রিল ২০১৫ মাদারপুর ডিমভাঙ্গা থেকে ৬ কেজি হেরোইন ও ১৩ লক্ষ টাকাসহ তারেক নামক এক গডফাদারকে গ্রেফতার করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা ইউনিটের একটি দল। গোদাগাড়ী পৌর ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনিরুল ইসলামসহ চার ভাই আবদুর রহিম টিপু, মেহেদী হাসান ও সোহেল রানা এরা সকলেই মাদকের গডফাদার। সবশেষ ৪ কেজি ৩০০ গ্রাম হেরোইন পাচারের অভিযোগে ৭ মে ২০২৪ গোদাগাড়ী থানায় টিপুর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।
২৪ মে ২০২৫ সারাংপুর জামাতির মোড় এলাকার সাইফুল ইসলাম (৫৫) ও তার ছেলে আশিক হোসেন (২৬) কে ৬ কেজি ৭শ গ্রাম হেরোইন ও নগদ ১ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা জব্দ করা হয়। রাজশাহীতে মাদক মামলায় বাবা-ছেলের যাবজ্জীবন দেয়া হয়। ২ মে ২০২৫ কাকনহাট বাজার থেকে মাদক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী শ্রী ব্যাজন মার্ডি‘কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বিজ্ঞ আদালত ৩ বছরের সাজা দেয় মার্ডিকে। পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে বেশ কিছু মাদক ব্যবসায়ী জামিনে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে তার মধ্যে ফাজিলপুর গ্রামের বাসেতের ছেলে দুলাল, শহিদুলসহ অনেকেই। এরা ছাড়াও গোদাগাড়ীতে বহু লোক মাদককের সাথে জড়িত আছে বলে এলাকা ঘুরে জানা যায়।

উপজেলায় প্রতি মাসে আইন শৃঙ্খলা মিটিং এ মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়ীর সামনে ‘‘মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ী” লিখা সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙ্গানোর কথা বলা হলেও কার্যত এমন সুন্দর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি কোন প্রশাসন।

ফলে মাদককারবারীদের দৌরাত্ম দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। তারা প্রশাসন কিংবা কোন মানুষকে মানুষই মনে করে না। কথায় আছে ‘‘চোরের মার বড় গলা” এভাবেই চলাফেরা করে সর্বত্রই। অনেক জায়গা আছে যেগুলোতে হাত বাড়ালেই মাদক পাওয়া যায়। মাদক যদি সহজলোভ্য হয় তাহলে জাতির কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।

এদিকে মাদকের ছোবল থেকে রেহায় পাচ্ছে না। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা। শিক্ষিত অনার্স-মাস্টার্স পাস অনেক যুবক মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়নি। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয়পায় সকলেই। শ্রীমন্তপুর গ্রামের মাস্টার্স পাস ডাবলু নামের এক যুবক মাদক সেবন করতে করতে মাতা, স্ত্রী ও কন্যাকে রেখে মারা যায়। তারই উচ্চ শিক্ষিত ছোট ভাই মাদক গ্রহণ করার কারণে তার রেলবাজারের স্ত্রী শিশু বাচ্চাসহ ছেড়ে চলে যায়। মাদক সহজলভ্য হওয়ায় মরণঘাতী মাদকের ছোবল থেকে বাঁচার উপায় পাচ্ছে না কেউই। তবে প্রশাসন চাইলেই মাদক নির্মুল করা সম্ভব, বলছেন বিশিষ্টজনেরা।

গোদাগাড়ী মডেল থানার হিসাবমতে গত মে মাসের মাদক মামলার বিবরণ: মাদক মামলা হয়েছে ২২টি, আসামী ২৮ জন, তার মধ্যে হেরোইন ২কেজি ৬২৪ গ্রাম, গাঁজা ৫কেজি ৯৯০ গ্রাম, চোলাইমদ ২৪৪৫ লি. ফেন্সিডিল ৩০ বোতল।

মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে বিধান প্রণয়নের জন্য প্রণীত আইন, এস, আর, ও নং ৩৬২-আইন/২০১৮, তারিখঃ ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ইং দ্বারা ১৩ পৌষ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ উক্ত আইন কার্যকর হয়েছে। এসব আইন ঘেঁটে দেখা গেছে মাদক নিমূলের কোন আইন নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণের আইন আছে। তাই সরকার কিংবা যে কোন প্রশাসন মাদক নির্মুল করতে পারবে না বরং প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে আপাতত মনে হচ্ছে।

গত ১৭ এপ্রিল গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল আহমেদ মাদারপুর গ্রামের শাহাদাত ও অজ্ঞাত এক মাদক ব্যবসায়ীকে পুন:র্বাসন করেন এবং কেউ যদি স্বেচ্ছায় মাদক ব্যবসা বাদ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায় তাহলে প্রশাসন তাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে বলে জানান ইউএনও ফয়সাল আহমেদ।

হরহামেশায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় “মাদকের রাজধানী গোদাগাড়ী” এভাবে শিরোনাম দেখলেই ভ্রুকুঁচকে উঠে। বাসে উঠে গোদাগাড়ীর নাম শুনলেই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আপদমস্তক চেক করে। এতে যারা ভালো মানুষ তারা ভীষন লজ্জা পায়।
রামনগর মসজিদের ইমাম মাও. সাব্বির জানান মাদকের কারণে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রাণঘাতী মাদক থেকে বাঁচতে ইসলামী সু-শিক্ষা ও আখেরাতের ভয় জরুরী। যাদের ভিতরে কুরআনের আলোয় আলোকিত থাকবে ৫ ওয়াক্ত স্বলাত আদায় করবে তারা কখনো মাদক গ্রহণ কিংবা মাদকের সাথে জড়িত হবে না। আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন।