এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির,বাগেরহাট:
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে । বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর গত ৫ আগস্ট থেকেই উপজেলার সর্বত্র মারপিট, ভাংচুর, লুট, চুরি, দখল ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে চলছে।
ইতোমধ্যে মোরেলগঞ্জে কমপক্ষে ১২টি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ইউনিয়ন পরিষদ ভাংচুর, লুট, বহু দোকান বন্ধ করে দেওয়া ও মৎস্য ঘের দখলের ঘটনা ঘটেছে। থানা পুলিশ নির্লিপ্ত থাকায় অবাধে চলছে এসব তাণ্ডব। বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন আওয়ামী ঘরানার নেতা, কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃবৃন্দ।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পটপরিবর্তনের পর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, শতাধিক ঘের দখল, পঞ্চকরণ ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় ভাংচুর, শতাধিক পরিবারের লোকজন বাড়ি শূন্য হয়ে পড়েছে। রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের কাটাবুনিয়া গ্রামে মঙ্গলবার রার্তে ইউপি সদস্য শ্রমীক লীগ নেতা বাহার ফকির, আওয়ামী লীগ নেতা মুনসুর ফকির, হারুন ফকির, এসকেন্দার ফকির গ্রাম পুলিশ মোস্তফা খানসহ ৫ বসতবাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বিভিন্ন মালামাল লুট করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
এর আগে,মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ফাসিয়াতলা গ্রামের নুরুজ্জামান আকন, মনির আকন, বড়পরি গ্রামের ইউপি সদস্য মহিদুল ইসলাম, কাটাবুনিয়া গ্রামের বাহার ফকির, মুনসুর ফকির, হারুন ফকির, এসকেন্দার ফকির ও গ্রাম পুলিশ মোস্তফা খানের বসতবাড়ির মালামাল লুট করে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম পুলিশ মোস্তফা খানের স্ত্রী মিনা বেগম ও ইউপি মেম্বার বাহার ফকির বলেন, রাত ১১টার দিকে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি বাহিনী একযোগে ৪টি ঘরের মালামাল লুট করে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তারা ৩টি গরু, ৫০ টি হাস ও ঘরের যাবতীয় মামলামাল ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়।
এ জমি দখলের চেষ্টা টের পেয়ে আশপাসের লোকজন ঘটনাস্থল আসলে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ভয়-ভীতি দেখায়। ততক্ষনে দুষ্কৃতিকারীর জনসাধারনের টের পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।গ্রাম পুলিশ মোস্তফা খানের স্ত্রী মিনা বেগম জানান, রাত ১১টার দিকে ২০-থেকে ২৫ জনের একটি সংঘবদ্ধদল প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা মুনসুর ফকিরের বাড়ি পর পর ৪টি ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে গ্রাম পুলিশ মোস্তফা খানের পাকা ভবনে পেট্রোল দিয়ে আগুন দেয় বিভিন্ন মামলামাল লুট করে নিয়ে যায়। এখনও ওই গ্রামের ৯টি পরিবারের কিছু মানুষ বাড়ি ছাড়া নারীরা থাকলে তারা রয়েছে আতংকে। বনগ্রাম ইউনিয়নের ইউপি সদস্য যুবলীগ নেতা রমেশ মুখাজির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, খাউলিয়া ইউনিয়নের সাবেক নারী সংরক্ষিত ইউপি সদস্য শাহানাজ বেগম, ইউপি সদস্য মহিদুল ইসলাম, ফাসিয়া তলা গ্রামের মনিরুজ্জামান আকন, তার ভাই মনির আকন, প্রধান শিক্ষক মোস্তফা মাষ্টার ও মজিবুল বয়াতির বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়াও মঙ্গলবার দিনে ও রাতে বারইখালী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান বিপুর বাড়িতে হামলা, নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক মেম্বর ফরিদুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান জসিম মৃধা, মো. আনোয়ার হোসেন, লুৎফর চৌকিদার ও ফারুক দফাদার, কামরুল ইসলাম পলাশের বাড়িতে হামলা ভাংচুর ঘটনা ঘটেছে।
তেলিগাতি ইউপি চেয়ারম্যান মোর্শেদা আক্তার বলেন, তার দুটি মৎস্য ঘেরের মাছ লুট করে নিয়েছে ও বসতবাড়ি থেকে গরু ও ছাগল নিয়ে গেছে। এছাড়াও ঢুলিগাতি ৪টি দোকান ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এখনও বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
পঞ্চকরণ ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক মজুমদার জানান, মঙ্গলবার বিকেলে কতিপয় লোকজন তার ইউনিয়ন পরিষদে ঢুকে কয়েকটি কক্ষ ভাংচুর চালিয়েছে। ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা বদিউজ্জামান মজুমদারের মৎস্য ঘেরের মাছ লুট করে নিয়েছে। ৫ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য আবদুল লতিফ হাওলাদারের মৎস্য ঘের দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এদিকে বহরবুনিয়া ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক মৎস্য ঘের দখল হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
মোরেলগঞ্জ থানার কার্যক্রম বন্ধ থাকার করনে ওই এলাকার জনসাধারনের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এবিষয়ে উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, অনাকাঙ্খিত যা কিছু ঘটছে এর কোন ঘটনার সাথে জামায়তে ইসলামী বা ছাত্র শিবিরের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা বিভিন্ন এলাকায় পাহারা বসিয়েছি।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মো. শহিদুল হক বাবুল বলেন, জেলা বিএনপির নির্দেশনা অনুযায়ী নেতাকর্মীরা গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের জান মাল রক্ষার্থে কমিটি করে পাহারা দিচ্ছেন। এ দেশ রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। কোন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তবে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করছি।
বিএনপিনেতাতাঁতী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক ড.কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, দেশের চলমান প্রেক্ষাপটে তরুন প্রজন্ম ছাত্রদের বিজয় হয়েছে। এ বিজয় ধরে রাখতে প্রতিহিংসা দূর করতে হবে, সকলের সম্বলিতভাবে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে। দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ কোন ভাবে করতে দেওয়া হবে না। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের এ নির্দেশনা। জনগনের জান মাল রক্ষা করতে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ তাদের সুরক্ষায় নেতাকর্মীদের পাসে থেকে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি।এলাকার আইন শৃংখলায় জনগনের জান মাল রক্ষার্থে বিএনপির সকল নেতাকর্মীদের ইতোমধ্যে মহল্লায় মহল্লায় কমিটি গঠন করে সংখ্যালঘুদের মন্দির পাহারায় জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানার জন্য থানার ওসি মোহাম্মদ সামসুদ্দিনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে থাকায় কেউই থানা পুলিশের সাড়া ও সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। বাগেরহাট-৪ (মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের জামায়েত নেতা অধ্যক্ষ আবদুল আলীম বলেন, এলাকার আইন শৃংখলায় জনগনের জান মাল রক্ষার্থে বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামি মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা শাখার সকল নেতাকর্মীদের ইতোমধ্যে মহল্লায় মহল্লায় কমিটি গঠন করে সংখ্যালঘুদের মন্দির পাহারায় জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।