সাইদ সাজু, তানোর থেকে : রাজশাহীর তানোরে নিহত শিশু সাজিদ যে সেচ পাম্পের পরিত্যক্ত (বোরিং) গর্তে পড়ে গিয়েছিল, সেটি খনন করেছিলেন স্থানীয় কছির উদ্দিন। নিজের প্রভাব বিস্তার ও গ্রামবাসির বাধা উপেক্ষা করে অবৈধ সেচ পাম্পের বোরিং করেন। তবে উপজেলার কোয়েলহাট পুর্বপাড়া গ্রামে এই সেচ পাম্প স্থাপনের জন্য উপজেলা সেচ কমিটির কোনো অনুমোদন নেননি। তিনি পানির ব্যবসা করেন। ঘটনার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি।তবে ঘনিষ্ঠরা সাজিদ হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন মহলে দৌড়-ঝাঁপ করছে। সাজিদের পরিবার যেনো মামলা না করে সেই জন্য বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তদ্বির চলছে। দুই বছরের শিশু সাজিদ গত বুধবার দুপুরের দিকে ওই গর্তে পড়ে যায়। এরপর বেলা ২টা ৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ৩২ ঘণ্টা পর গত বৃহস্পতিবার রাতে সাজিদের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। জানা যায়, কছির দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। দেশে ফেরার পর পানির ব্যবসা শুরু করেন। এলাকায় পাঁচটি অগভীর নলকুপ (সেমিডিপ) বসিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে একটি সেমিডিপ চালান মৎস্য খামারের নামে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে। দুটি বিদ্যুতের সংযোগ আছে সেচ নামেই। বাকি দুটি অন্য ব্যক্তির সেমিডিপ থেকে জোরপুর্বক অবৈধভাবে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে চালান তিনি। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তিনি সেমিডিপ চালান। এদিকে পানির ব্যবসায় ভালো লাভ হওয়ায় প্রায় এক বছর আগে শিশু সাজিদদের বাড়ির পাশে নিজের জমিতে কছির আরেকটি সেমিডিপ বসানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য পরপর তিনটি স্থানে তিনি মিস্ত্রিদের দিয়ে বোরিং করান। কিন্তু ১২০ ফুটের পর সেখানে পানি পাওয়া যায়নি। বরং, বোরিংয়ের পাইপ দিয়ে পাথর উঠে আসছিল। তাই সেখানে আর সেমিডিপ বসানো হয়নি। তবে বোরিং গুলো মাটি দিয়ে ভরাট না করেই উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখেন। নিহত সাজিদের মা রুনা খাতুন বলেন, ‘কছির উদ্দিন তিন জায়গা বোরিং (বোরহোল) করে ফেলে রেখেছিল। তাঁর কারণে আমার সাজিদ মারা গেল। আমি কছির উদ্দিনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ রুনার কথার সত্যতা পাওয়া যায় তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু পূর্ব দিকে যেতেই। এখানেই একটি সরু গর্ত উন্মুক্ত অবস্থায় দেখা যায়। লোকজন সেটি ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। শিশু সাজিদ বোরিংয়ের গর্তে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন কছির উদ্দিন। তিনি বাড়িতে নেই। মোবাইল ফোনও বন্ধ। তিন দিন ধরে তাঁর কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি। তাঁর অবহেলার শাস্তি দাবি করেছেন নিহত সাজিদের বাবা রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শুধু তাঁর অবহেলার জন্য আমার একটা কলিজা আমি হারিয়ে ফেললাম। প্রশাসন সবই দেখেছে। আমি তাদের কাছে একটা সুষ্ঠু বিচার চাই।’ তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাঈমা খান বলেন, ‘কছির উদ্দিনের অবহেলার কারণে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। ভিকটিমের পরিবার যেভাবে চাইবে, সেভাবে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ ইউএনও নাঈমা খান পদাধিকার বলে উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি। তিনি জানান, আগে থেকেই কছির উদ্দিনের কয়েকটি সেচ পাম্প আছে বলে তিনি শুনেছেন। সেগুলো বৈধ কি না, তা যাচাই করতে হবে। তবে যে সেচ পাম্পের বোরহোলে পড়ে সাজিদের মৃত্যু হয়েছে, সেটির জন্য কছির উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন নেননি। তিনি বেআইনি কাজ করেছিলেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সবকিছুই দেখছি। ব্যবস্থা হবে তবে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তিনি।’ এদিকে গত শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে কোয়েলহাট গ্রামের মাঠেই জানাজা শেষে এলাকার গোরস্থানে সাজিদের মরদেহ সমাহিত করা হয়। তার জানাজায় দূরদূরান্ত থেকে আসা হাজারো মানুষ অংশ নেন। শিশু সাজিদের মৃত্যুতে পুরো এলাকার মানুষ শোকাহত। একই সঙ্গে তারা ক্ষুব্ধ। রাকিবুলের আত্মীয় রা বলেন, ‘একজন ব্যক্তির অবহেলায় এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। যিনি এ ঘটনার জন্য দায়ী, তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।’এলাকার বাসিন্দারা বলেন, ‘৫৫ ফুট নিচে আটকে শিশুর মৃত্যু আমাদের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। মায়ের চোখের সামনে সন্তান যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল, এ দৃশ্য কারও সহ্য করা কঠিন। এদিকে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতা বিত্তশালী কছির উদ্দিন ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে কথা বলে এলাকায় টিকে থাকা যেখানে যা কারো জন্য ছিলো অত্যন্ত কঠিন। সেখানে সাজিদের দরিদ্র পিতা কছিরের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারবে না এটাই বাস্তবতা। তাই বলে কি সাজিদ নিহতের কোনো বিচার হবে না ? তারা উচ্চ আদালত এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। উল্লেখ্য শিশু সাজিদের পিতা রাকিব এখনো কোনো মামলা বা অভিযোগ করেননি।


















