প্রচ্ছদ অন্যান্য পৃষ্ঠা ভোলাহাটে আশ্রয়ন  প্রকল্পের বাড়ী নির্মাণে অনিয়ম ও দূনীর্তির পাহাড়

ভোলাহাটে আশ্রয়ন  প্রকল্পের বাড়ী নির্মাণে অনিয়ম ও দূনীর্তির পাহাড়

173
0
ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)প্রতিনিধিঃ বিনা মূল্যে জায়গাসহ পাকা ঘরের মালিক-এমন স্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে। তবে স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে ফারাক অনেক। কিন্তু কে জানত দরিদ্র মানুষের সাধ আর সাধ্যের সেতুবন্ধন গড়ে দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা! বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের এই স্বপ্নপূরণের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
রঙিন টিনে মোড়ানো পাকা ঘরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের এই উদ্যোগ প্রশংসাও পায়। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কিছু দায়িত্বশীলদের লোভের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়ার আশঙ্কায় ভোলাহাটের দরিদ্র মানুষের সোনালি স্বপ্ন। তাদের জীবনে নেমে আসতে পারে অমানিশার অন্ধকার। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে তারা যে ঘর পাবেন, তা দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এতে যে কোনো বৈরী আবহাওয়ায় তা ধসে পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ভোলাহাট উপজেলায় সব থেকে বেশী সংখ্যক ভূমিহীনদের গৃহ উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গরীব মানুষকে দেয়া উপহারের বাড়ী নির্মাণে নানা অনিয়ম দূনীর্তির অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঘর নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে ১,২ ও ৩ নাম্বর ইট। এর মধ্যে ২ ও ৩ নাম্বর ইট বেশী নামকাস্তে ১ নং ইট রয়েছে। ভরাট বালি দিয়ে ইটের গাঁথনি ও প্লাস্টার করা হচ্ছে।
এদিকে যে সকল উপকারভোগী বাড়ী পাবে তাদের দিয়ে ঘরের মেঝে ভরাট করিয়ে নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও টিন সেট করতে নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ ঘর দিয়ে পানি পড়ছে। পলিথিন দিয়ে পানি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন অনেকেই।
ভোলাহাট সদর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড়ের চৌটাদহে ২০টি বাড়ী নিমার্ণ হচ্ছে। সেখানে গিয়ে ঘর নিমার্ণে নিয়োজিত রাজমিস্ত্রী মোঃ হাসনাত জানান, ২ ও ৩ নং ইট দিয়ে ঘর গাঁথা হচ্ছে। অপর একজন মিস্ত্রী  মোঃ আব্দুল বাশির বলেন, ১ ও ২ নং ইট দিয়ে ঘর নিমার্ণ করা হচ্ছে। মিস্ত্রী হেল্পার দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্লাস্টার ও ইট গাঁথার কাজের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এদিকে বালি ও সিমেন্টের ভাগে রয়েছে অনিয়ম। উপকারভোগি মাজিরন জানান, আমি ৩ হাজার ৩’শ টাকা দিয়ে ঘরের মেঝে ভরাট করেছি। তিনি বলেন, মেঝে ভরার্ট করতে বলেছে অফিসের লোকজন। সবাই নিজ খরচে ঘরের মেঝেতে মাটি ভরাট করেছেন। গোহালবাড়ী ইউনিয়নের হলদেগাছীতে মোট ১৩ জন ভূমিহীন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপহার। ঘরে উঠতে উঠতেই ফাটল ধরেছে। উপজেলা প্রকল্প অফিস থেকে তড়িঘড়ি মেরামতের কাজও শুরু করেছেন। হলদেগাছীর মোঃ কালু বলেন, আমার ঘর ভেঙ্গে গেলে অফিস থেকে মিস্ত্রী পাঠিয়ে মেরামত করে দেন। তিনি বলেন, আমার পাশের বাড়ীটিও ফাটল ধরেছে।
এদিকে দলদলী ইউনিয়নে পঞ্চানন্দপুর মাঠপাড়া গ্রামে ওয়াল গাঁধা শেষ হতে না হতেই ফাটল ধরেছে। সেখানে মেরামতও চলছে লুকোচুরির অন্তরালে। জামবাড়ীয়া ইউনিয়নের আন্দিপুর গ্রামের চিত্র  একই। ভোলাহাটের যেদিকে চোখ যাবে ঘর নির্মাণে নানা অনিয়ম-দূর্নীতির পাহাড়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।  উপকারভোগি মোসাঃ রহিমা বলেন, ঘরের ভিতর শুয়ে থাকতে ভয় লাগছে। পানি বা বাতাস হলে কখন বুকের উপর ভেঙ্গে পড়ে। বৃষ্টি হলে ঘরের ভিতর পানি পড়ে। উপরে পলিথিন দিয়ে পানি থেকে সাময়িক রক্ষা হচ্ছে। ঘরে টিনের ছাউনিতে যে সব কাঠ দেয়া হয়েছে ঐ কাঠ পোকাতে খেয়ে কাঠের গুড়া বিছানাই পড়ে খাবার ও বিছানা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।নকশাবহির্ভূতভাবে প্রাক্কলনের চেয়ে কম ও নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় এগুলো পরিণত হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসস্থলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসাবে যে ঘর দেওয়া হবে, গরিবের সেই ঘর নির্মাণে চুরি নয়, যেন ডাকাতি হচ্ছে। এই ঘর নির্মাণের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে কোনো মজবুত ভিত্তি নেই। প্রাক্কলনে দেড় ফুট পরিমাণ ইটের ১০ ইঞ্চি গাঁথুনি দেওয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ঘরেই তা দেওয়া হচ্ছে না। কোনো ঘরে এক ফুট আবার কোনো কোনো ঘরে মাটির লেভেলেই দুটি করে ইট বিছিয়ে তার উপর থেকেই ৩ ইঞ্চি গাঁথুনি দিয়ে দেওয়াল তোলা হয়েছে। এতে অল্পমাত্রার ভূমিকম্প কিংবা টানা বৃষ্টিতেও এই ঘর ধসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। আরেকটি বিপজ্জনক দিক হচ্ছে-দেওয়াল ধরে রাখার জন্য লিংটেল অপরিহার্য। অথচ ঘরের জানালার ওপর যে ছোট লিংটেল দেওয়া হয়েছে, তা-ও রডের খাঁচা ছাড়াই ঢালাই দেওয়া হয়েছে।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার বিভিন্ন প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে জড়িত থাকা একজন অভিযোগ করে বলেন খোদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রকল্প বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উপহারে অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন সাবেক ইউএনও মশিউর রহমানের হাত ধরে শুরু হওয়া আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর কাজ শুরু  হয় অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে। আর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কাউছার আলম সরকার,উপজেলা পরিষদ এবং  ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের যোগসাজশে এই  অনিয়ম-দূর্নীতির মত ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ  করনে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ কাউছার আলম সরকার জানান, বাড়ী নির্মাণে সরকারের ডিজাইন ভুল ছিলো। অল্প টাকায় এ বাড়ী নির্মাণ সম্ভব নয়। তবে অনিয়ম-দূনীর্তির বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং যে সব বাড়ীতে ফাটল ধরেছে বা ভেঙ্গে গেছে সেগুলো মেরামতের পর সংবাদ প্রকাশ করার অনুরোধ করেন।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমর কুমার পালের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি অনিময়-দূনীর্তির বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, যে সব কাজ হয়েছে সব মানসসম্মত হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোন অভিযোগ নেই।
উল্লেখ্য, ভোলাহাট উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ১’শ ৬০ টি, দিত্বীয় পর্যায়ে ৪’শ ১১ টি ও তৃতীয় পর্যায়ে ৪’শ টি বাড়ি বরাদ্দ হয়েছে।ভোলাহাটে বরাদ্দকৃত মোট ৯৭১ টি প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের বাড়িগুলো যেন সরকারি নিয়মবহির্ভূতভাবে না হয় সেজন্য সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা।