আমিনুল হক ছিলেন দ্রত ধাবমান একজন পথিক। তিনি শুধু গোদাগাড়ী-তারোনের নেতা ছিলেন না তিনি ছিলেন পুরো উত্তর বঙ্গের অবিসাংবাদিত কিংবদোন্তি আলোকবতির্কা। জীবনকে, জীবনের বিভিন্ন রুপকে,জীবনের বিভিন্ন আবেদনকে তিনি চেষ্টা করেছেন মানুষের কাজে, দেশের কাজে, অধিকারের কাজে ব্যবহার করতে। কখনও তিনি একজন ধার্মিক, একজন সূফী, কখনও তিনি মনে প্রানে একজন আদর্শ শিক্ষক। কখনও একজন আইনজীবী। আইনের রক্ষা কবজ দিয়ে চেষ্টা করেছেন মানুষ দেশ ও দলকে রক্ষা করতে। কখনও রাজনীতির অঙ্গনে নেমে এসেছেন দেশ ও মানুষের সংগ্রামে, সম্মানে আর অধিকার আদায়ে শামিল হতে। তখন তিনি একজন সংগ্রামী রাজনীতিক। তবে জীবনের সব অবস্থায় চেষ্টা করেছেন পবিত্র জ্ঞানে মানুষ ও দেশকে সবকিছুর উর্ধ্বে সম্মান দিতে। জীবনের কাছে চাওয়া খুব একটা বেশি ছিল না।

জীবনের অন্যতম ভালোবাসা ছিলো পড়াশুনা। আইন পেশায় থাকবার সময় কোর্ট থেকে ও চেম্বার শেষ করে ফিরবার পর খাওয়া দাওয়া শেষে বড় এক মগ কফিসহ চলে যেতেন পড়ার লাইব্রেরিতে। ফযরের আযান পর্যন্ত চলতো পষরবহঃ দের নথি দেখা ও পরবর্তী দিনের মামলার জন্য নিজেকে তৈরি করা।

ছোট বাচ্চাদের পড়ার টেবিলের মতন আমিনুল হকের ফাইলের নিচে ফাইলের ফাঁকে ফাঁকে থাকতো ধর্মের বই, সাহিত্যের বই, রাজনীতির বই, মূলত সব পড়া একসঙ্গে করতেন। পড়ার বড় টেবিলটা বই ও ফাইলে ভরে থাকতো, পাশে টেবিল ল্যাম্পটা স্নিগ্ধ আলো ছড়াতো। সারারাত মিউজিক প্লেয়ারে বাজতো রবি শংকরের সেতার, মেহেদি হাসান, সাবরি ব্রাদার, নুসরাত ফতে আলী এবং বিভিন্ন রাগ সংগীত। আমিনুল হক লেখাপড়া শেষ করে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে, ঢাকা ‘ল’ কলেজে এবং আইন পেশার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বারো বছর শিক্ষকতা করেন। দুইবার সিভিল সার্ভিস পদে চান্স পান। কিন্তু প্রশাসনের যে বিভাগে তিনি (কাস্টমস) সুযোগ পান সেটা পছন্দ মতো না হওয়ায় তিনি সরকারি চাকরিতে জয়েন করেন নি। এছাড়াও বিজ্ঞ অভিভাবকরা বুঝতে পেরেছিলেন এগারোটা মামলা মাথায় নিয়ে সরকারি চাকরি পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর কোনভাবেই…………

ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময় আমিনুল হক তখন প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র। মিছিলে অংশ নিতে স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়েন। মিছিল ছত্রভঙ্গ করবার জন্য পুলিশ ধর-পাকড় করলে আরও অনেকের মতন তিনিও এরেস্ট হন।ষাটের দশকে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুর” হয়। তিনি ভাসানী ন্যাপের অনুসারী। ঊনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের কারণে আমিনুল হকের বিরুদ্ধে নয়টি মামলা হয়েছিল। পাক সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে দেশ ত্যাগ করে লন্ডনে ‘ব্যারিস্টার’ পড়বার জন্য যান।আমিনুল হক ১৯৭১ সালে লিন্কন-ইনে ছাত্র হিসাবে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। ‘৭১’ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুর” হলে লন্ডনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে অনশনে অংশ নেন।

আমিনুল হক লন্ডনের লিন্কন- ইন হতে ইধৎৎরংঃবৎ – অঃ – খধি ডিগ্রি শেষ করে ১৯৭৬ সালে দেশে ফিরেন।

১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাগদল৷ গঠন করলে তিনি জাগদলে এবং জাগদল বিলুপ্ত হয়ে বিএনপি গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুমুল পর্যায়ে পৌছালে সেই বছর ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা হস্তন্তর করেন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নিকট। শাহাবুদ্দিন সরকার ৯১ সালে দেশের সকল দলকে সাথে নিয়ে ফেব্র”য়ারী মাসে সংসদীয় ভোট দেন। ভোটে প্রথমবার গোদাগাড়ী-তানোর থেকে অংশ নেন বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ব্যারিস্টার আমিনুল হক। জাতীয় সংসদের রাজশাহী -১ আসনে প্রদত্ত মোট বৈধ ভোটের শতকরা ৭০% পেয়ে বিএনপি থেকে নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার আমিনুল হক। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত বিএনপি সরকারের আইন-বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এবং পরবর্তী সময়ে সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব পালন করেন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ সাল বিভিন্ন কারণে দেশের রাজনীতিতে একটি উলেখযোগ্য বছর। এ বছরই অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদের দুটো’ নির্বাচন। ষষ্ঠ সংসদ ছিল বিএনপির গনতন্ত্র আর আইনের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দেশের সংসদীয় ইতিহাসে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। রাজশাহী -১ আসনে (গোদাগাড়ী -তানোর) ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিএনপি-র প্রার্থী হিসেবে ৮৩,৯৯৪ ভোটে বিজয়ী হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী পান ২৮,৯৯১ ভোট। দ্বিতীয় ধাপে ২০০১-২০০৬ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংখ্যা গরিষ্ঠ দল বিএনপি সরকার গঠন করলে জনাব আমিনুল হক টি এন্ড টি মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হোন।

চারবার এমপি ও দুই বার মন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর স্বপ্নে গোদাগাড়ী ও তানোরের অভূতপূর্ব উন্নতি করেন।
গোদাগাড়ী ও তানোরে ইধৎৎরংঃবৎ আমিনুল হক প্রথম আওয়ামী লীগের বাইরে জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী হিসেবে জয় লাভ করেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ও এই আসনটি আওয়ামী লীগের ছিলো। আমিনুল হক শুধুমাত্র নিজের আসন নয় পুরো উত্তরবঙ্গকে বিএনপির উন্নয়নের ছায়াতলে আনবার জন্য প্রচেষ্টা করেন।

উত্তরবঙ্গ ও ধানের শীষ এক সময় এক অর্থ বহন করতো।
ঢাকার মিরপুরের পূর্ব মনিপুর,অনেক অলি গলির মধ্যে মসজিদ। নাম বাইতুর রহিম জামে মসজিদ। এই মসজিদে দেখা পান উনার পরম প্রিয় আধ্যাত্মিক ও অন্তরের প্রিয় বাবা উনার মুর্শিদ কেবলা হযরত সৈয়দ রশিদ আহমদ জৌনপুরী (রাহঃ) এর। বাবা সৈয়দ রশিদ আহমদ জৌনপুরী (রহঃ) ১১২ বছর বয়সে ওফাত বরণ করেন।

আমিনুল হক এই আধ্যাত্ম গুরুর কাছে হতে জীবনের পরবর্তী আসল জীবনের অনেক কিছু জানবার চেষ্টা করেছেন। জীবনের অন্তরালের অতলাতন জীবনে অবগাহনের চেষ্টা করেছেন। অনেক অন্য রাজনীতিবিদের ন্যায় আমিনুল হকের সম্ভনরা শৈশব থেকে বাবার পথ চেয়ে বড় হয়েছে। ওদের দিন শুরু হতো সেই মাঝরাতে। বাবা সব দায়িত্ব শেষ করে পরিশ্রান্ত হয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফিরতো তখন বাড়িটার দিন শুরু হতো,বাবার সাথে খাবার আশায় কথা বাবার আশায়,একটু ছুঁয়ে দেখবার আশায়,তাদের প্রতীক্ষিত চোখ অপেক্ষা করত। ওদের প্রিয় বাবাকে কোনদিনও ওভাবে পাওয়া হলো না। এখনো বাবার জন্য অন্তরের চাওয়া অন্তরের প্রতীক্ষা একটা ক্ষত হয়ে আছে। যেটা অন্তরের অনেক গভীরে পাথর ভার হয়ে জীবনকে রক্তাক্ত করে,ব্যথিত করে।

 

(৭) আমিনুল হক সময়ের কাছে সবকিছু ছেড়ে চলে গেছেন।

আমিনুল হক গণতন্ত্রের জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্র উনাকে সেই ভাবেই সম্মান এবং মূল্যায়ন করেছে যতদিন গণতন্ত্র ছিল এই দেশে।সন্তানদের বাবার জন্য অপেক্ষার শেষ হয়নি। ওরা বিশ্বাস করে……. আবার দেখা হবে প্রিয় আব্বু ওহংযধ অষষধয, ঐঊ রিষষ ৎবঁহরঃব ঁং ধষষ রহ ঔধহহধয.

আমিনুল হকের এই রাজনীতির মাঠে পথচলা শুরু হয় কৈশোর থেকে। প্রাঙ্গণে আগুন দেওয়ার অপরাধে অনেকের সাথে আমিনুল হককেও কারাবরণ করতে হয়। সেখান থেকে শুরু। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পথ চলেছেন একইভাবে। শেষ দিনও আমিনুল হক ২০১৮ নির্বাচনের প্রায় অনেকগুলো আসামির জামিন করান……….., সেটাই আমিনুল হকের কর্মময় জীবনের শেষ দিন।
রাজনৈতিক মামলা ও গোদাগাড়ী- তানোরের প্রিয় মানুষগুলো প্রতিদিন হাইকোর্টে উপস্থিত থাকতো দলের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিষয় এছাড়াাও চোখের দেখা হৃদয়ের দেখার জন্য। আমিনুল হক ৩ (তিন দিনের জন্য) সিঙ্গাপুরে যান, রিটার্ন টিকিট ছিল। যাবার সময় গোপনে যেতে হতো এবং হাইকোর্টের পারমিশান নিতে হতো। কারণ দেশের প্রতিটি জায়গায় বিরোধী রাজনীতিকদের হেনস্তার জন্য প্রস্তত থাকতে হয়।

কিন্তু আল্লাহর বিধান ভিন্ন ছিল। তিন দিন গড়িয়ে দীর্ঘদিন হয় এবং সেটাই জীবনের শেষ বিদায়।

আভা হক
ব্যারিস্টার আমিনুল হকের সহধর্মীনী
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর