প্রচ্ছদ অন্যান্য পৃষ্ঠা আনক্যাটাগরি আমনের ভরা মৌসুমেও নওগাঁয় চালের বাজার উর্ধগতি

আমনের ভরা মৌসুমেও নওগাঁয় চালের বাজার উর্ধগতি

124
0

শামীম আনসারী, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি:  খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা নওগাঁয় আমনের ভরা মৌসুমেও চালের বাজার ঊদ্ধগতি। গত বছরের শুরু থেকেই দফায় দফায় সব ধরণের চালের দাম বেড়েছে। তবে এবার বেড়েছে সরু জাতের চালের দাম। গত এক সপ্তারের ব্যবধানে এবার বেড়েছে বোরো মৌসুমের জিরা, কাটারি, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় সরু ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে। শম্পা কাটারি জাতের চাল এক সপ্তাহ আগে ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছিল, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ টাকায়। অন্যদিকে মোটা জাতের স্বর্ণা চালের দাম কেজিতে ৩ টাকা পর্যন্ত কমে এখন ৪৪ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। নতুন আমন মৌসুমের চালের সরবরাহ বাড়ায় দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের মোকাম নওগাঁয় মোটা চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা পর্যন্ত কমেছে। তবে কেজিতে তিন থেকে চার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে সরু ও মাঝারি জাতের চালের দাম।
নওগাঁ শহরের আলুপট্টি এলাকায় চালের মোকামে বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক সপ্তাহ আগে যে স্বর্ণা-৫ ও গুটি স্বর্ণা জাতের চালের বস্তা (৫০ কেজি) বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৫০ টাকায়, তা এখন ২ হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর সরু চালের (মিনিকেট ও শম্পা কাটারি) দাম বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ জাতের চাল বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আমন মৌসুমের ধান স্বর্ণা-৫ ও গুটি স্বর্ণা ধানের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এসব ধানের দাম পড়ে গেছে। ফলে মোটা চালের দাম কমেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মোটা চালের দাম আরও কমতে পারে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে বোরো মৌসুমের জিরা, কাটারি, বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় সরু ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে। সরু ও মাঝারি জাতের চালের দাম আর কমার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন মিলমালিক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বোরো মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। এ পরিমাণ জমি থেকে চালের উৎপাদন হয় ৮ লাখ ১৮ হাজার ২৩৬ মেট্রিক টন। চিকন জাতের ধানের উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৩০ হেক্টর জমিতে। এ পরিমাণ জমি থেকে ধান উৎপাদন ৬ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন এবং চাল ৪ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন।
জেলার পাইকারি ও পৌর খুচরা চাল বাজার সূত্রে জানা যায়, পাইকারিতে সরু ও মাঝারি ব্রি-২৮ চালের দাম বর্তমানে প্রতি কেজি ৪৮-৪৯ টাকা, আগে ছিল ৪৫-৪৬ টাকা, ব্রি-২৯ চালের দাম বর্তমানে প্রতি কেজি ৪৬-৪৭ টাকা, আগে ছিল ৪৪-৪৫ টাকা, মিনিকেট চালের দাম বর্তমানে প্রতি কেজি ৫৪-৫৫ টাকা, আগে ছিল ৫৩-৫৪ টাকা, নাজিরশাইল বা সম্পা কাটারি এক সিদ্ধ চাল ২-৩ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি কেজি ৬২-৬৩ টাকা ও দুই সিদ্ধ চালের দাম প্রতি কেজি ৫৮-৫৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মোটা জাতের স্বর্ণা চালের দাম ৩৯-৪০ টাকা এবং গুটি ৩৮-৩৯ টাকা।
খুচরা বাজারে ৪-৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে ব্রি-২৮ চালের দাম বর্তমানে প্রতি কেজি ৫২-৫৪ টাকা, ব্রি-২৯ চাল প্রতি কেজি ৪৮-৫০ টাকা, মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬০-৬২ টাকা, নাজিরশাইল বা সম্পা কাটারি প্রকারভেদে প্রতি কেজি ৬০-৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মোটা জাতের চালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মোটা চালের দাম কমতে পারে।
বোরো মৌসুমে সরু ও মাঝারি জাতের ধান উৎপাদন হয়। সরু ও মাঝারি চাল হিসেবে পরিচিত জিরাশাইল ও কাটারি জাতের চালের চাহিদা রয়েছে প্রচুর। বছরে একবার ধান উৎপাদন হওয়ায় সারা বছর তার ওপর নির্ভর করতে হয়। এ ধান থেকে বছরে ৮ থেকে ৯ মাস চাহিদা পুরনের পর শেষ সময় এসে দাম বাড়তে থাকে। সব শ্রেনী পেশার মানুষের খাদ্যভাস পরিবর্তন হয়েছে। দিনমজুরাও মোটা চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত না। তারা এখন সরু ও মাঝারি জাতের চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত। বোরো মৌসুমের জিরাশাইল ও কাটারি ধানের সরবরাহ এখন বাজারে নেই বললেই চলে।
শহরের চকবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা নুরু ইসলাম বলেন, তার বাড়ি সদস্য সংখ্যা ছয়জন। প্রতিদিন ২কেজি চাল লাগে। খুচরা বাজার থেকে ১০ কেজি করে চাল কিনা হয়। এতে যতদিন যায় আরকি। মোটা চালের ভাত ভাল লাগে না এবং খাওয়ার সময় তৃপ্তি পাওয়া যায়না। কষ্ট হলেও চিকন চালের ভাত খাই। বাজারে চাল কিনতে গিয়ে দেখি কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে।
নওগাঁ উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, আমি ইটভাটায় কাজ করি। প্রতিদিন ৩৫০ টাকা করে পাই। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫জন। প্রতিদিন কেনা প্রতিদিন খাওয়া। গত এক সপ্তাহ আগে যে চাল ৪৬ টাকা কেজি কিনেছিলাম এখন সেটা ৫০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। চালের দাম বাড়ায় আমাদের মতো শ্রমজীবীদের জন্য সমস্যা হচ্ছে।
নওগাঁ শহরের পৌর খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারন সম্পাদক উত্তম কুমার সরকার বলেন, মোকাম থেকেই সরু ও মাঝারি চাল বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই সরু ও মাঝারি জাতের চাল বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতাদের চালের দাম বাড়ানো বা কমানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা খুচরা চাল বিক্রেতা পাইকারী চাল ক্রয় করে কেজি প্রতি সামান্য কিছু লাভে বিক্রি করে থাকি। চালের বাজার মাঝে মধ্যেই উঠা নামা করে।
মহাদেবপুর বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা তাজিমুদ্দীন শেখ বলেন, সব ধরনের মানুষের কাছে কাটারি চালের চাহিদা বেশি। ভ্যান চালক ও দিনমজুরাও এখন চিকন চালের ভাত খেতে অভ্যস্ত। তারা ভাবে এক মুঠ ভাত খাবে যেন একটু শান্তিতে খেতে পারে। কাটারি’র পর জিরাশাইল চালের চাহিদা রয়েছে। প্রতিদিন ৫ বস্তা (প্রতি বস্তা ৫০ কেজি) কাটারি ও ২ বস্তা জিরাশাইল বিক্রি করতে পারি।
নওগাঁ মহাদেবপুর উপজেলার মের্সাস রাসেদ ট্রেডার্স রাইস মিলের মালিক রাশেদুজ্জামান রাশেদ বলেন, গত ৫-৭ দিন ধরে নতুন ধানের (স্বর্ণা-৫ ও গুটি স্বর্ণা) দাম কমতে শুরু করেছে। যেসব জেলায় বড় বড় আড়ত আছে, সেখানেও ধানের দাম কমতির দিকে। প্রতি মণ ধানের দাম আগের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বর্তমানে নওগাঁর বাজারে প্রতি মণ স্বর্ণা-৫ ও গুটি স্বর্ণা ধান হাজার টাকা থেকে ৮শত ৯০টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁ চাউল আড়ৎদার সমিতির সভাপতি নিরদ বরণ সাহা বলেন, বোরো ধান বছরে এক বার উৎপাদন হয়। যা সারা বছর এ ধানের ওপর নির্ভর করতে হয়। ইতোমধ্যে বছরের ৮মাস চলে গেছে। স্বাভাবিক ভাবে যখন ফসল উৎপাদন হয় তখন আমদানি বেশি থাকে এবং দামও কম হয়। জিরাশাইল চাল যা মিনিগেট নামে পরিচিত। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছে চিকন ধান ও চালের পরিমাণ কমে আসছে। চালের দাম বাড়ার মুল কারণ হচ্ছে বাজারে চালের পরিমাণ কমে গেছে। আর এ কারণে বাজারে চিকন বা সরু ও মাঝারি জাতের চালের দাম বেড়েছে। চালের দাম কমার জন্য আগামী বছরের বোরো ধান উৎপাদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।#