প্রচ্ছদ অন্যান্য পৃষ্ঠা গোমস্তাপুরের মেহেরুল হত্যাকাণ্ডে ধরা ছোয়ার বাইরে আসামীরা

গোমস্তাপুরের মেহেরুল হত্যাকাণ্ডে ধরা ছোয়ার বাইরে আসামীরা

280
0

ইয়াহিয়া খান রুবেল, গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাগঞ্জ) প্রতিনিধি : প্রতিবন্ধী মা আনোয়ারীর (৫৫)একমাত্র সন্তান মেহেরুল ইসলাম (৩২)। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রাজারামপুর এলাকার বাসিন্দা তারা। পিতৃহারা মেহেরুল পেয়ারবাগানে শ্রমিকের কাজ করতো। গেল বছরের ২১ ডিসেম্বর বেগমনগরের দিয়ারাপাড়ায় মেহেরুলের লাশ পাওয়া যায়।সেদিনই তার মামা এনারুল ইসলাম গোমস্তাপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। কিন্তু, মেহেরুল হত্যাকণ্ডের ৫ মাস পার হয়ে গেলেও এখনো কোন আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা।
পিতৃহারা, দিন আনে দিন খায় পরিবারের প্রতিবন্ধী মায়ের একমাত্র সন্তান মেহেরুলকে কি কারণে আর কারাই বা হত্যা করতে পারে এ নিয়ে গোমস্তাপুর উপজেলার এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা গেছে।আর দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে কোন আসামী গ্রেফতার না হওয়াই অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন এটা কি কোন পারফেক্ট ক্রাইম ?
জানা যায়, মেহেরুলের গোমস্তাপুরের পেয়ারাবাগানে তার কাজের মেয়াদ শেষ হলে বাগানের মালিকের সঙ্গে হিসেব-নিকেষ চুকিয়ে মা ও খালার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসে গেল বছরের ২০ডিসেম্বর।সেদিনই খালার বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বের হয় সে।পরের দিন অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর তার বাড়ি থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে বেগমনগর দিয়ারাপাড়ার আম বাগানের মধ্যে মেহেরুলের লাশ পরে থাকতে দেখে গ্রামবাসী। পরে গোমস্তাপুর থানায় খবর দেয়া হয়।ঘটনাস্থলে পরে থাকা মেহেরুলের লাশের দুটি চোখ ছিল ক্ষত-বিক্ষত, অণ্ডকোষ ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে দেয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে মেহেরুলের পকেট থেকে দড়ি, বে¬ড ও বিড়ির প্যাকেট উদ্ধার করে পুলিশ।
হত্যার ঘটনায় মেহেরুলের মামা এনারুল ইসলাম গেল বছরের ২১ ডিসেম্বর গোমস্তাপুর থানায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামী করে মামলা করেন। পরে গোমস্তাপুর থানা পুলিশ থেকে মামলাটি সুরাহা করার দায়িত্ব পায় ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয় গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে মেহেরুলকে। এ বিষয়টিকে সামনে রেখে সিআইডি তদন্ত কাজ শুরু করে। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফরেনসিক রিপোর্ট ঘটনার পাঁচ মাস পরে তাদের হাতে আসেনি, এ কারণে মামলা তদন্তে সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান সিআইডি কর্মকর্তারা।
সিআইডি মামলাটি নিয়ে দৌড়ঝাপ শুরু করলে এখন পর্যন্ত দ্শ্যৃমান কোন ফলাফল দেখাতে পারেনি।ঘটনার পাঁচ মাস পরেও জিজ্ঞাসাবাদ ও অনুসন্ধানেই সীমিত রয়েছে মামলার কার্যক্রম।
মামলার বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান বলেন, এখনো তদন্ত চলছে।মামলার বাদী কোন রকম সাহায্য করছেননা বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। ধারণার উপর ভিত্তি করে কোন কিছু করা যায়না।তবে এখনো সিআইডি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।এদিকে মামলার বাদী মেহেরুলের মামা সিআইডির এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বলেন, তারা তথ্য গোপন করার লোক না। তথ্য দিচ্ছেননা সিআইডির এমন অভিযোগ সঠিক না। বলেন, তারা কোন চাপের মধ্যে নেই। ঘটনার কিছু বুঝতে পারছেননা বলেই তারা তেমন কোন তথ্য দিতে পারছেননা।
তবে মামলাটির বাদী এনারুলের স্ত্রী নাজমা খাতুন পলি প্রতিবেদককে জানান, মেহেরুল হত্যাকন্ডের একটা বড় কারণ পাওনা টাকা হতে পারে। বলেন, মেহেরুল ফটিক নামে তার এক বন্ধুকে ৭০ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন।দীর্ঘদিন ধরে ফটিক সেই টাকা পরিশোধ না করলে মেহেরুল তাকে টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেয়। ফটিক তার বন্ধু মেহেরুলকে অনেক সময় পাওনা টাকা চাওয়ার জন্য মারতে চায়তো বলেও অভিযোগ করেন মেহেরুলের মামী নাজমা খাতুন পলি। তবে ফটিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিবেদককে জানান, ৭০ হাজার নয় মেহেরুল তার কাছে ৩৫ হাজার টাকা পেত। আর মেহেরুলের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তিনি হত্যাকণ্ডের দিন বাড়িতেই ছিলেন। এসবে তার সংশি¬ষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
অপরাজেয় বাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায় মেহেরুল গেল বছরের ২০ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে বের হয়ে সন্ধ্যায় গোমস্তাপুর দাঁড়াবাজ মোড়ের আজিজুলের মুদীর দোকানে যান। আজিজুলকে তার পাওনা ২৯৫ টাকা পরিশোধ করে দোকান থেকে বের হয়ে যায় সে । দোকানের পাশে ছিলেন তার প্রতিবেশী এখলাস। এখলাস মেহেরুল কোথায় যাচ্ছে তা জানতে চান তার কাছে। মেহেরুল তাকে জানায়, সে গোমস্তাপুর যাবে আর সেখান থেকে একটা পিকনিকে অংশ নেবে। পরে সে একটি মোটরসাইকেলে করে চলে যায়। তবে এটি কার মোটরসাইকেল ছিল, চালকের মাথায় লাল রঙের হেলমেট, পরনে রেনকোট ও মাফলার থাকায় মোটরসাইকেল চালককে তিনি চিনতে পারেননি।
এদিকে মেহেরুল মুদি দোকানী আজিজুলকে গোমস্তাপুরের যে পিকনিকে অংশ নেবার কথা বলেছিল সেই পিকনিকে অংশ নেয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সংশি¬ষ্ট প্রতিবেদক। তারা জানান, পিকনিক ছিল ঐ ইউনিয়নের চৌকিদার স্টাফদের। তাই পিকনিকে মেহেরুলের অংশগ্রহণ করার কোন সুযোগ ছিলনা। তারপরেও সে পিকনিকে অংশ নেবার কথা কেন বলেছে তা তাদের জানা নেই। সে পিকনিকে আসেনি বলেও জানান তারা।
এদিকে সেদিনই একই এলাকার নূহ মার্কেটে আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আলামাসের চায়ের দোকানে যান মেহেরুল। তবে সেসময় মোটরসাইকেল চালককে তার পাশে দেখা যায়নি। চা দোকানদার আলমাস জানান, সে তার দোকানে প্রায় রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একায় একটা বেঞ্চে বসে ছিল।সে সময় তাকে খুব বিষন্নতা দেখাচ্ছিল বলে জানান চা দোকানদার। এরপর মেহেরুল চলে যায়।
তারপর থেকে মেহেরুলকে আর দেখা যায়নি।পরের দিন অর্থাৎ গেল বছরের ২১ ডিসেম্বর খুব ভোরে তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ পরে থাকতে দেখে এলাকাবাসী।
মেহেরুলের একাধিক প্রতিবেশি অপরাজেয় বাংলার সঙ্গে আলাপে জানান, হত্যাকণ্ডের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মেহেরুলের গতিবিধি সতর্ক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে হত্যা কাণ্ড রহস্যের কূল-কিনারা দ্রুত উদঘাটন করা সম্ভব হতো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেহেরুলের কয়েকজন প্রতিবেশি জানান, মেহেরুল একসময় পাশের গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করতেন।সেই সময় একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পরে সে। সেই সম্পর্কটা অনেকেই মেনে নিতে পারেননি।এ বিষয়টিও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসার দরকার বলে মনে করেন অনেকে। মেহেরুল হত্যাকণ্ডের পর ঐ এলাকায় একটি ঔষুধের দোকান কয়েক মাস বন্ধ থাকার বিষয়টিও সন্দেহের চোখে দেখছেন এলাকাবাসীর কেউ কেউ।
সিআইডি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, তারা বেশ কিছু ঘটনাকে সামনে রেখে তদন্ত করছেন।তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাবেনা। তবে হত্যাকারী যে বা যারাই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সিআইডির এই কর্মকর্তা।
গোমস্তাপুরের সচেতন এলাকাবাসী বলছেন পারফেক্ট ক্রাইম বলে কিছু নেই। পারফেক্ট ক্রাইম হয় তদন্তে ঘাটতির জন্য। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মনযোগ দিয়ে কাজ করলেই দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে মেহেরুল হত্যাকণ্ডের যে রহস্য উন্মোচিত হয়নি, তা অবশ্যই উন্মোচিত হবে। দোষীরা থাকবে আইনের কাঠগড়ায়। প্রতিবন্ধী মা আনোয়ারী এখনো একমাত্র সন্তান মেহেরুলের ছবি বুকে নিয়ে অশ্রুঝরা চোখে তাকিয়ে আছেন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর দিকে, ন্যায় বিচারের আশায়। তার এই প্রতীক্ষা কি অচিরেই শেষ হবে ?